আন্তর্জাতিক

প্রতিরোধের মুখে রুশ সেনারা

ইউক্রেনে রুশ সেনারা প্রতিরোধের মুখে পড়েছেন। কয়েকটি শহরে পথে পথে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হচ্ছে। গতকাল রোববার রুশ বাহিনী ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে ঢুকলেও তাঁদের প্রতিহত করার কথা জানিয়েছে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ। রাজধানীকেও রুশ সেনামুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে তারা। যুদ্ধ থেকে বাঁচতে লাখ লাখ মানুষ ইউক্রেন ছাড়ছেন।

এই পরিস্থিতিতে রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থা সুইফট থেকে দেশটির কয়েকটি ব্যাংককে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। একই সঙ্গে ইউক্রেনে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠানো অব্যাহত রেখেছে তারা। গতকাল ইউরোপীয় ইউনিয়নও দেশটিতে অস্ত্র সরবরাহ শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ কাজ করছে তারা। বিজ্ঞাপন

অবশ্য রাশিয়া হামলা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নতুন হুমকি দিচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সেনাবাহিনীকে পরমাণু অস্ত্রের বহর প্রস্তুত রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। গতকাল শীর্ষস্থানীয় সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেছেন, পশ্চিমারা রাশিয়ার প্রতি ‘অবন্ধুসুলভ পদক্ষেপ’ নিয়েছে। তারা অবৈধ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পরমাণু অস্ত্র নিয়ে পুতিনের এমন পদক্ষেপের সমালোচনা করে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, এটা অগ্রহণযোগ্য। আর ন্যাটোপ্রধান ইয়ানেস স্টলটেনবার্গ একে বিপজ্জনক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন আখ্যায়িত করেছেন।

রাশিয়ার চার দিনের হামলায় ইউক্রেনের ২১০ জনের বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে দেশটির সরকার জানিয়েছে। অন্যদিকে ৪ হাজার ৩০০ রুশ সেনা নিহত হওয়ার দাবি করেছে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ। তবে এ বিষয়ে রাশিয়ার পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। গোয়েন্দা তথ্যের বরাত দিয়ে পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলছেন, যা ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে বেশি সংখ্যায় রাশিয়ার সেনারা হতাহত হচ্ছেন। তাঁরা ইউক্রেন বাহিনীর শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়ছেন।

ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ

গতকাল ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের খেরশন ও নোভা কাখোভকা এবং পূর্বাঞ্চলীয় বারদিয়ানস্ক শহর দখলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন রুশ সেনারা। আগের দিন দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় মালিতোপোল এলাকা দখলে নেন তাঁরা। গতকাল রুশ বাহিনী ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে ঢোকার পর দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল গোলাগুলি হয়। গোলাগুলির ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে।

অবশ্য খারকিভে রুশ সেনাদের প্রতিহত করার দাবি করেছেন আঞ্চলিক গভর্নর ওলেহ সিনিহুবোভ। তিনি বলেন, খারকিভের সর্বত্র তাঁদের নিয়ন্ত্রণে। সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষীবাহিনী কাজ করছে। শহর পুরো শত্রুমুক্ত করা হচ্ছে।

রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাধারণ নাগরিকদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। এর মধ্যে রয়েছে পথনির্দেশক চিহ্নগুলো নষ্ট করা, রাস্তায় গাছ ফেলে পথ আটকে দেওয়া, ঘরে তৈরি পেট্রলবোমা ছুড়ে মারা, পরিবহন চলাচলের সংযোগস্থলগুলো ধ্বংস করা এবং রাতে বেশি সতর্ক থাকা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ইউক্রেনের সাধারণ নাগরিকেরা সড়কে প্রতিবন্ধকতা তৈরির জন্য ব্যাগে বালু ভরছেন। ভিডিওতে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি আগে কখনো এমন ঐক্য দেখিনি। সবাই ব্যাগে বালু ভরছেন, সবাই সর্বোচ্চটা করছেন। এখানে বহু ব্যাগ। ইউক্রেনের গৌরব।’

কোথাও কোথাও খালি হাতে রুশ বাহিনীর ট্যাংকের সামনে দাঁড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষ।

কিয়েভে আর ‘রুশ সেনা নেই’

রুশ বাহিনী গত বৃহস্পতিবার হামলা শুরুর দিনেই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ থেকে ১৫-২০ কিলোমিটার দূরের হোস্টোমেল বিমানঘাঁটি দখলে নেয়। পরদিন শুক্রবার কিয়েভের উপকণ্ঠে রুশ সেনাদের দেখা যায়। সেখানে বিভিন্ন স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র ও গোলা নিক্ষেপের পাশাপাশি রুশ সেনাদের আক্রমণও চলতে থাকে। কিন্তু শনিবার রাতে ইউক্রেনের সেনারা তাদের রুখে দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। গতকাল একটি ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিরোধ করেছি। সফলভাবে শত্রু আক্রমণ রুখে দিয়েছি।’ আর কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিৎসকো বলেন, শহরে আর কোনো রুশ সেনা নেই। সেনাবাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সীমান্তরক্ষীরা নাশকতাকারীদের শনাক্ত ও নিরস্ত্র করার কাজ অব্যাহত রেখেছেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শনিবার রাতভর কিয়েভে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। গতকাল সকাল নয়টার আগে আগে বিমান হামলার সতর্কতামূলক সাইরেন বেজে ওঠার পর তিনটি বিস্ফোরণ ঘটে। রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে কিয়েভের দক্ষিণ-পশ্চিমের ভাসিলকিভ এলাকার একটি তেল সংরক্ষণাগারে।

রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা

রাশিয়াকে বিশ্বব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্রসহ ইউরোপের বেশির ভাগ দেশের আকাশসীমায় রাশিয়ার উড়োজাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের পাশাপাশি রাশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এখন আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেনের ব্যবস্থা সুইফট থেকে দেশটির কয়েকটি ব্যাংককে নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বেলজিয়ামভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন বা সুইফট হলো দ্রুত ও নিরাপদে আন্তর্জাতিক লেনদেনের প্রধান ব্যবস্থা। বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশের ১১ হাজার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সুইফট যুক্ত। এর আগে শুধু ইরানকে সুইফট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। তাতে দেশটির বৈদেশিক বাণিজ্য ৩০ শতাংশ কমে গিয়েছিল।

বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। গুগল রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম আরটি ও অন্যান্য চ্যানেলের ওয়েবসাইট, অ্যাপ এবং ইউটিউবে বিজ্ঞাপন থেকে অর্থ আয়ের পথ বন্ধ করে দিয়েছে। একই পদক্ষেপ নিয়েছে ফেসবুকও।

যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ চলছেই

যুদ্ধ থেকে বাঁচতে ইউক্রেন ছেড়ে পালাচ্ছেন মানুষ। গতকাল পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৬৮ হাজার ছাড়িয়েছে বলে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে।

যুদ্ধবিরতি নিয়ে বেলারুশ সীমান্তে রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে রাজি হয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। গতকাল বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার লুকাশেঙ্কোর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর সম্মতি দিয়েছেন তিনি।

এরই মধ্যে দেশে দেশে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল রাশিয়ার মস্কোসহ ৪৪টি শহরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। জার্মানির রাজধানী বার্লিনে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন লক্ষাধিক মানুষ।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button